logo

কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ : সূচনা পর্ব

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে একটি নতুন রাজনৈতিক পরিকাঠামো আত্মপ্রকাশ করে। সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপগুলিকে সাংগঠনিক রূপ দিতে থাকে। এই সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার দরুণ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাও প্রসারিত হতে থাকে। অবশ্য এই আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা প্রসারের জন্য একাধিক প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলার নদিয়া জেলায় আধুনিক শিক্ষার প্রসারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও মিশনারি শিক্ষার অবদান নেহাত কম ছিল না। নদিয়া জেলার নবদ্বীপ তো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত ছিলই। কৃষ্ণনগর, শান্তিপুরের মতো জনপদও মধ্যযুগ থেকে বাংলার শিক্ষা সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নবদ্বীপে বহু সংস্কৃত পণ্ডিতের বাস ছিল। আর কৃষ্ণনগর শহর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল মধ্যযুগে। রাজা রাঘব মাটিয়ারি ছেড়ে রেউই (কৃষ্ণনগর) গ্রামে তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। সেখানে রাজদরবারকে কেন্দ্র করে বিদ্যানদের সমাগম ছিল লক্ষণীয়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এহেন নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে সরকারি মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়, যা আধুনিক ও পাশ্চাত্য শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ঐতিহ্যমন্ডিত কৃষ্ণনগর কলেজ ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে তার পথচলা শুরু করে এবং সময়ের সাথে সাথে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করে তুলতে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

অবিভক্ত নদিয়া জেলা আয়তনে স্বাধীনোত্তর নদিয়া জেলার প্রায় দ্বিগুণ ছিল। অবিভক্ত নদিয়া জেলা রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া এই পাঁচটি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল। কৃষ্ণনগর কলেজ নদিয়া জেলার প্রাচীনতম কলেজ তো ছিলই, বাংলারও প্রাচীনতম কলেজগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জের আমলে (১৮৪৪- ১৮৪৮ খ্রিঃ) এই মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। কৃষ্ণনগর কলেজ আক্ষরিক অর্থে পথ চলা শুরু করে বা এর আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাকাল হল ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি। জাতপাত নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি উন্মুক্ত ছিল। বিখ্যাত শেক্সপেরিয়ান স্কলার D.L. Richardson ছিলেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। তিনি ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে নভেম্বরই অধ্যক্ষের দায়িত্বভার পেয়ে যান। সেইসময় কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজ অভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। প্রতিষ্ঠানটির প্রথম যৌথ শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে অধ্যক্ষ ডি.এল. রিচার্ডসন ছাড়াও আরো তিনজন ইউরোপীয় শিক্ষক ব্রাডবুরি, বিটসন ও বিনল্যান্ড ছিলেন এবং ছিলেন দশজন ভারতীয় শিক্ষক। এহেন সমৃদ্ধ ফ্যাকাল্টি নিয়েই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণনগর কলেজ পথ চলতে শুরু করেছিল।

কৃষ্ণনগর কলেজ এবং কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল প্রথমে মাসিক ১২৫ টাকা দিয়ে একটি ভাড়া বাড়িতে শুরু হয়। প্রথম বছরে কলেজ এবং স্কুলের মোট ছাত্রসংখ্যা ছিল ২৪৬ জন। এর মধ্যে মাত্র ৮ জন ছিল কলেজ বিভাগে। ডি.এল. রিচার্ডসনের পর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হন Mr. Rochfort, যার সময় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালো অগ্রগতি হয়। তিনি ১৮৪৬-এর ডিসেম্বর থেকে ১৮৫৫-র ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। এই সময় ১৯৪৭ সালের শেষে মোট ছাত্রসংখ্যা বেড়ে হয় ২৫৮ জন, যার মধ্যে ২ জন মুসলমান ও ২ জন খ্রিস্টান ছাত্র ছিল বলেও জানা যায়। কৃষ্ণনগর কলেজ পরিচালনার জন্য প্রথমে একটি লোকাল কমিটি নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮৪৮ সালের ২২শে জুন কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব এই লোকাল কমিটির হাত থেকে স্থানান্তরিত করা হয় Council of Education-এর হাতে। Council of Education-এর তরফ থেকে Mr. Drinkwater Bethune ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তার বক্তৃতায় কৃষ্ণনগর কলেজের মাধ্যমে নদিয়া ও প্রতিবেশী জেলাগুলিতে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর ব্রিটিশ উদ্দেশ্য নদিয়াবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়। বেথুন সাহেব নদিয়া জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজে নারীদের বিশেষ অধিকার দেওয়ার প্রসঙ্গে বক্তব্যও রাখেন। এই সকল ঘটনাবলীর মাধ্যমে নদিয়া জেলায় আধুনিক শিক্ষা ও চিন্তাধারা বিস্তারের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।

কৃষ্ণনগর কলেজের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গেলে বারংবার সেখানকার রাজা ও রাজপরিবার সম্পর্কিত কিছু ঘটনা প্রসঙ্গক্রমে চলেই আসে। রাজা গিরীশচন্দ্রের দত্তক পুত্র মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের কথা এখানে বলতেই হয়। রাজা শ্রীশচন্দ্র তাঁদের পারিবারিক প্রথার অবহেলা করে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র কুমার সতীশচন্দ্রকে কৃষ্ণনগর কলেজে পাঠদান করেছিলেন। ইতিপূর্বে এদেশের পুরাতন রাজবংশোদ্ভূত ভূম্যধিকারীরা নিজেদের পুত্রদের কোনো কলেজে বা স্কুলে দিতেন না। কারণ সেখানে তাদের সাধারণ বালকদের সাথে একাসনে বসতে হবে ও কলেজের সাধারণ নিয়ম পালন করতে হবে। কিন্তু রাজা শ্রীশচন্দ্র এবিষয়ে ব্যতিক্রমী ছিলেন। আগাগোড়াই ইউরোপীয় রীতিনীতি জানার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। কিন্তু পিতার ভয়ে নিজের মনোমত কাজ করতে পারেন নি। তিনি নিজে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইংরাজি ভাষা পড়তে আরম্ভ করেছিলেন। রাজা গিরীশচন্দ্রের পরলোকগমনের পর রাজা শ্রীশচন্দ্র তাঁর পুত্র সতীশচন্দ্রকে কলেজে পাঠান এবং নিজেও কলেজ কমিটির সভ্য হন। তিনি এই কমিটির প্রতি অধিবেশনকালে উপস্থিত থেকে সভার কার্য নির্বাহ করতেন এবং প্রতি বছর ছাত্রদের বঙ্গভাষার পরীক্ষার ভার নিতেন।

সমকালীন একাধিক ঘটনার সাক্ষী কৃষ্ণনগরের এই কলেজ গৃহ। রাজা শ্রীশচন্দ্র ইংরেজ গভর্নমেন্টের থেকে মহারাজা উপাধির ফরমান লাভ করেছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজ গৃহে। গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই এই ফরমান পাঠান। নদিয়া জেলার কালেক্টর সাহেব কৃষ্ণনগরের কলেজ গৃহে বহু সমারোহের সাথে সভা করে রাজা শ্রীশচন্দ্রকে ঐ ফরমান প্রদান করেন। রাজা সতীশচন্দ্রের সাথেও কৃষ্ণনগর কলেজের বিশেষ সম্পর্ক ছিল, অথবা এমনটি বললে আরো সঠিক হবে যে তাঁর সাথে কলেজের পরিচালকদের বিশেষ সখ্যতা ছিল। তাঁর অকাল প্রয়াণ সকলকে বেদনা দিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে কৃষ্ণনগর কলেজে ছাত্রদের পারিতোষিক প্রদানের যে সভা হয়, সেখানে কলেজের অধ্যক্ষ স্যামুয়েল লব সাহেবের বক্তব্যটি এখানে উল্লেখনীয়। তিনি সেদিন বলেছিলেন— “এখানকার ইংরাজ ও বাঙালীদিগের মধ্যে মহারাজা গ্রন্থিস্বরূপ ছিলেন, তাঁহার অভাবে সেই গ্রন্থি ছিন্ন হইয়াছে, এবং অচিরাৎ আর কেহ যে ঐরূপ গ্রন্থিস্বরূপ হইবেন তাহারও প্রত্যাশা নাই।”

এবার কৃষ্ণনগর কলেজের নতুন ভবনটির নির্মাণ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা যাক। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজ তার নবনির্মিত ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছিল, বর্তমানে সেই ভবনটিই আমরা দেখতে পাই। এই নতুন ভবনটি নির্মাণ করতে সে সময়ে খরচ হয়েছিল ৬৬,৮৭৬ টাকা, যার মধ্যে ১৭,০০০ টাকা নদিয়া জেলার বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া গিয়েছিল। আর কলেজের নতুন জায়গার ১০০ বিঘা জমির দুই তৃতীয়াংশ নদিয়ার মহারাজ শ্রীশচন্দ্র রায় ও কাশিমবাজারের মহারাণী স্বর্ণময়ীর দান থেকে পাওয়া যায়। কৃষ্ণনগর কলেজের নতুন ভবন নির্মাণে নদিয়া-রাজের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এমনিতেই নদিয়া তথা বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির বিবর্তনের সাক্ষী এই রাজবংশ। দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায় মহারাজা শ্রীশচন্দ্র সম্পর্কে লিখেছেন- “সংস্কৃত ও ইংরেজি উভয় বিদ্যার উন্নতি বিষয়ে তাহার যথেষ্ট উৎসাহ ও যত্ন ছিল। অধ্যাপকগণকে যথাসাধ্য আনুকূল্য করিতেন এবং তাহাদের টোলের ব্যয়ের জন্য বার্ষিক বৃত্তিও দিতেন। কৃষ্ণনগর কলেজ গৃহ নির্মণার্থ এ জেলার সমস্ত ভূম্যধিকারী অপেক্ষা, অধিক অর্থ প্রদান এবং ঐ বাটীর জন্য, তাহার অধিকারস্থ যে ভূমির প্রয়োজন হয়, তাহা দান করেন।”

কৃষ্ণনগর কলেজের নতুন ভবনে আনুষ্ঠানিক ভাবে কাজকর্ম শুরু হয় ১৮৫৬ সালের ১লা জুন। কলেজের নতুন অধ্যক্ষ হয়ে আসেন Mr.R.Lodge। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত (১৮৫৭ খ্রি.) হওয়ার পর কৃষ্ণনগর কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও সরকার কর্তৃক গ্রান্ট ইন এড্ সিস্টেম চালু করা হলে কৃষ্ণনগর কলেজ উক্ত সাহায্য লাভ করে। বর্ধিত কর্মচারীর মাধ্যমে ১৮৬৫ সালে বি.এ. এবং ল ক্লাস শুরু হয়। কলেজের সিনিয়র ডিপার্টমেন্টে ছাত্রসংখ্যা ১৮৬৪ সালে ছিল ৬১, যেটা ১৮৭০ সালে বেড়ে হয় ১২৭। কিন্তু এই ছাত্রদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন জমিদার বংশের সন্তান। তবে ধীরে ধীরে সাধারণ ঘরের সন্তানরাও উচ্চশিক্ষার দিকে আকৃষ্ট হয়। কৃষ্ণনগর কলেজে এম.এ. ক্লাস শুরু হয় ১৮৭০ সালে এবং সার্ভে ডিপার্টমেন্ট খোলা হয় ১৮৭২ সালের আগস্ট মাসে। এক বছর পর First Arts পরীক্ষার জন্য কেমিস্ট্রিকে বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়।

অবিভক্ত নদিয়া জেলা তথা সমগ্র বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতিতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষগণ, অধ্যাপকবর্গ এবং অবশ্যই কৃতী ছাত্রবৃন্দকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে সুপ্রসিদ্ধ ডি.এল. রিচার্ডসন সাহেব প্রথম অধ্যক্ষ হয়ে আসেন। রামতনু লাহিড়ী একশত টাকা বেতনে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরের লাহিড়ী পরিবার নদিয়ায় আধুনিক শিক্ষা ও চিন্তাধারা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এই বংশেরই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন বাবু রামতনু লাহিড়ী, যিনি কৃষ্ণনগর কলেজ তথা বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। লাহিড়ী বংশের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বরেন্দ্রভূমির অর্থাৎ রাজশাহী পরগণার কুলীন ব্রাহ্মণ। অনুমান সেখান থেকে বিবাহসূত্রে তাঁরা কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’-এ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেখানে রাজার পারিষদবর্গের মধ্যে লাহিড়ী পরিবারের দুই ভাইয়ের উল্লেখ রয়েছে—

“কিঙ্কর লাহিড়ী দ্বিজ মুনসী প্রধান।

তার ভাই গোবিন্দ লাহিড়ী গুণবান্।।”

রামতনু লাহিড়ীর সহোদর শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ী দেশের বালকদের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিজ বাসভবনে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন এবং নিজেই সেখানে শিক্ষা দিতেন। ‘ক্ষিতীশ-বংশাবলী-চরিত’-এ দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায় লিখেছেন— “১২৪৩ কি ৪৪ বাঃ অব্দে, কৃষ্ণনগরনিবাসী দেশহিতৈষী শ্রীযুক্ত শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ি নিজ নিকেতনে এক অবৈতনিক ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। …তিনি আন্তরিক যত্ন ও পরিশ্রমপূর্বক অধ্যাপনা করিতেন এবং দরিদ্র ছাত্রগণকে পাঠ্যপুস্তক ও কাগজ কলম দিতেন। এই সকল কারণে, অনতিকাল মধ্যে, তাহার বিদ্যালয়ে অনেক বালক পড়িতে লাগিল। ইদানীং এ প্রদেশে ইংরাজি বিদ্যা শিক্ষার যেরূপ আগ্রহ হইয়াছে, তদানীং সেরূপ ছিল না, তথাপি, ছাত্রের সংখ্যা প্রায় এক শত হইয়াছিল।”

বাবু রামতনু লাহিড়ী এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রথম থেকেই কৃষ্ণনগর কলেজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বাবু রামতনু লাহিড়ীর মতো জ্ঞানদীপ্ত শিক্ষক থাকার দরুণ ছাত্রদের মানসিকতা উন্মুক্ত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। রামতনু লাহিড়ী সমাজচিন্তা ও শিক্ষাচিন্তায় হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর পথকেই অনুসরণ করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত রামতনু লাহিড়ী আধুনিক সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। রামতনু লাহিড়ীর সান্নিধ্যে কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্ররা হিন্দু বিধবাদের পুনঃবিবাহের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার পবিত্র শপথ গ্রহণ করেন। কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্ররা বাবু রামতনু লাহিড়ীর কাছ থেকে আধুনিক চিন্তাধারা ও কুসংস্কার মুক্ত জীবনযাপন প্রণালী অধ্যয়ন করেন। রামতনু লাহিড়ী বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকতা করেছিলেন। তবে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার সময় তিনি কৃষ্ণনগর কলেজেই ছিলেন। ১৮৬৫ সালের নভেম্বর মাসে পেনসন নিয়ে তিনি কর্ম থেকে অবসর নেন। তিনি যখন পেনসনের জন্য আবেদন করেন তখন কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন মি. আলফ্রেড স্মিথ। লাহিড়ী মহাশয়ের আবেদন ডিরেক্টারের কাছে প্রেরণ করার সময় স্মিথ সাহেব লিখেছিলেন— “In parting with Baboo Ram Tanoo Lahiri I may be allowed to say that Government will lose the services of an educational officer, than whom no officer has discharged his public duties with greater fidelity, zeal and devotion, or has laboured more assiduously and successfully for the moral elevation of his pupils.” এর থেকেই কৃষ্ণনগর কলেজের শিক্ষক হিসাবে রামতনু লাহিড়ীর গুরুত্ব অনুভব করা যায়।

উনিশ শতকের ষাটের দশকে কৃষ্ণনগর কলেজকে সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়েছিল। এইসময় শহরে মহামারী এবং ম্যালেরিয়ার প্রকোপে কলেজের ছাত্রসংখ্যা কমতে থাকে। ১৮৭১ সালে বি.এ. ক্লাসের পতন হবার সঙ্গে সঙ্গে এই ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিষ্ঠানটি তার প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা হারায়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান খুব দ্রুত এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। তিন বছর পর যখন লেফটেনেন্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পেল এই প্রতিষ্ঠানে আসেন তখন তিনি বেশকিছু শর্তের বিনিময়ে পুনরায় বি.এ. ক্লাস চালু করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণনগর কলেজ তার হৃত গৌরব পুনরায় ফিরে পায় এবং প্রথম শ্রেণীর কলেজের মর্যাদা লাভ করে। এই সকল উদ্যোগের সাথে সাথে কৃষ্ণনগর কলেজ তার পরবর্তী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ায়।

দীপাঞ্জন দে - আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক, নদিয়া।

কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ : কিছুটা পথ পেরিয়ে

‘কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ : সূচনা পর্ব’— এই বিষয়ে একটি লেখা ইতিপূর্বে প্রকাশিত হওয়ায়, এখানে কিছুটা পথ পেরিয়ে কলেজের কথা শুরু করলাম। লেখার খেই ধরতে এই স্মরণিকার পাঠকদের আগের লেখাটি (গুগল সার্চে মিলবে) পড়ে দেখতে অনুরোধ করবো। …১৮৭৪- ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণনগর কলেজের (তখন ‘কৃষ্ণনগর কলেজ’  নামটিই ব্যবহৃত হতো) অধ্যক্ষ ছিলেন Sir Roper Lethbridge. তাঁর মতো প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের অধীনে এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। তিনি অক্সফোর্ড থেকে ক্লাসিকস ও ম্যাথম্যাটিকসে ডবল অনার্স নিয়ে পাশ করেছিলেন। সেই সময় থেকে কলেজের ছাত্রসংখ্যা পুনরায় বাড়তে থাকে। কলেজে বিজ্ঞান ও কলা উভয় বিষয়েই শিক্ষা দেওয়া হতে থাকে। এমনকি বিজ্ঞানের বাড়তি চাহিদা মেটাতে ১৮৮০ সালে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার জন্য ল্যাবরেটরি খোলা হয়। এই ল্যাবরেটরি ১৯০৪ সালে পুনরায় বর্ধিত করা হয়। বিংশ শতকে কৃষ্ণনগর কলেজের কলেবর এভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।

কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্রদের পড়াশোনায় উৎসাহিত করার জন্য কয়েকটি পুরষ্কারের প্রচলন করা হয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি এবিষয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগের কথাও স্মরণ করতে হয়। ১৮৮৩ সালে বাবু মোহিনী মোহন রায়ের উদ্যোগে ৮০ টাকা অর্থমূল্যের পুরষ্কারের প্রচলন হয়। এই পুরষ্কারটি সেই কৃতী ছাত্রকে দেওয়া হত যে ছাত্রটি সেই বছরে বি.এ. এবং এম.এ. পরীক্ষাতে সবথেকে সফল ছিল। বাবু শ্যামাচরণ মৈত্র ৮ টাকা অর্থমূল্যের একটি পুরষ্কারের সূচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। এই পুরষ্কারটির নাম ছিল ‘Smith and Macdonell Prize’ (Bengal District Gazetteers : Nadia, J.H.E. Garrate)। এই পুরষ্কার বছরে একবার দেওয়া হত সেই ছাত্রকে, যে এফ.এ. পরীক্ষায় সবথেকে বেশি সফল হত এবং বি.এ. ক্লাসে পড়াশোনা চালাতে আগ্রহী হত। এইসকল পুরষ্কার সেসময় ছাত্রদের পড়াশোনার প্রতি বাড়তি আগ্রহ যুগিয়েছিল ধরা যেতে পারে। অসংখ্য কৃতী ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল করে কৃষ্ণনগর কলেজের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন।

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় আইন (Indian Universities Act of 1904) পাশ হয়। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯০৮-০৯ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজের পরিকাঠামোগত মানোন্নয়ন ঘটাতে বদ্ধপরিকর হয় এবং এই কলেজের হাল শক্ত হাতে ধরে। ১৯০৮ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশে কৃষ্ণনগর কলেজ ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল পৃথক হয়ে যায়। কৃষ্ণনগর কলেজ তার বর্তমান ভবনটিতেই থাকে, যেটি ১৮৫৬ সালে নির্মিত হয়েছিল। আর কলেজিয়েট স্কুল কলেজের পাশেই হৈমন্তী ভবনে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। অতঃপর এম.এ. এবং বি.এল. কোর্স বন্ধ করা হয়। আই.এসসি. এবং বি.এসসি. পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা অনুমোদিত হয়। ইংরেজি ও অঙ্কে অনার্স কোর্স এবং অর্থনীতি ও দর্শনে পাশ কোর্সের সূচনা করা হয়। কৃষ্ণনগর কলেজের প্রসিদ্ধ অধ্যক্ষগণ যথা রায়বাহাদুর জ্যোতিভূষণ ভাদুড়ী (১৮৯৮-১৯০৬ খ্রি.), সতীশচন্দ্র দে (১৯০৯-১৯১৬ খ্রি.) এবং R.N. Gilchrist (১৯১৬-১৯২১ খ্রি.)-এর আমলে কলেজ তার সমৃদ্ধি বজায় রাখে। ১৯০৮-০৯ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজ পরিচালনা সমিতি নিযুক্ত করা হয় এবং কলেজ কর্মচারী সভার সূচনা করা হয়। এই সময় কলেজ গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরিকে আরো সমৃদ্ধ করা হয়। ছাত্র তহবিল শুরু হয় ১৯২৯ সাল থেকে। কলেজের উন্নতি বাবদ প্রতি ছাত্র তাদের মাসিক মায়না থেকে এক আনা করে এই তহবিলে জমা করত। এছাড়া আরো নতুন তহবিলও গড়ে উঠতে দেখা যায়। এর মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ সিংহ রায় তহবিলের কথা স্মরণ করা যায়।

১৯০৫ সালে ছাত্রদের কমনরুম তৈরি করার সাথে সাথে কলেজ নতুন উদ্যমে জেগে ওঠে। এই কমনরুমের একটি অংশ হিসেবেই ১৯০৭ সালে ছাত্র ইউনিয়নেরও আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯০৮ সালে প্রথম কৃষ্ণনগর কলেজ পত্রিকা শুরু হয়। এই পত্রিকার নাম প্রথমে ছিল ‘Life and Light’ (Krishnagar College : Centenary Commemoration Volume)। তবে পরবর্তীতে এটি যখন ১৯১৫-র জুলাই মাসে প্রথম ছাপানো হয় তখন এটি কলেজ পত্রিকা নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন হেমন্তকুমার সরকার (শান্তিপুরের বাগআঁচড়া গ্রামে জন্ম, বিস্মৃতপ্রায় বিপ্লবী)। এই বালক পরবর্তীকালে একজন অন্যতম বিপ্লবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য দলের প্রধান হুইপ ছিলেন তিনি।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কৃষ্ণনগর কলেজের পড়াশোনা অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। এইসময় টানা একমাস কলেজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। এই অবস্থায় সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজমান ছিল এবং কৃষ্ণনগর কলেজ পরিচালনা করা রীতিমত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবুও অধ্যক্ষ Egerton Smith ১৯২২ সালে তাঁর অফিসিয়াল রিপোর্টে নদিয়া জেলায় কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের আবশ্যকতা সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছিলেন। ১৯২৭ সালের ১১ই জুলাই কৃষ্ণনগর কলেজের হিন্দু ছাত্রাবাস তার বর্তমান ভবনটিতে স্থানান্তরিত হয়। কৃষ্ণনগর কলেজের এই হিন্দু ছাত্রাবাসের নতুন ভবনটির উদ্বোধন করেন মহারাজা ক্ষৌণীশচন্দ্র রায়। এই হিন্দু ছাত্রাবাস প্রথমে ২০ জন ছাত্রকে নিয়ে শুরু হয়েছিল ১৮৭৬ সালের জুন মাসে। আর কৃষ্ণনগর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাস ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে মাত্র চারজন ছাত্রকে নিয়ে শুরু হয়। পরবর্তীতে স্যার আজিজুল হকের দ্বারা ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে এই মুসলিম ছাত্রাবাসটি   ‘অ্যান্ডারসন মুসলিম ছাত্রাবাস’ নাম নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। ১৯৩৮-৪০ সালের মধ্যে কৃষ্ণনগর কলেজ আরো কিছুটা সম্প্রসারিত হয়। ১৯৩৮ সালে কলেজে বিদ্যুতেরও ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৩২ সালে অধ্যক্ষ আর.এন. সেন পরীক্ষামূলকভাবে কৃষ্ণনগর কলেজে কো-এডুকেশনের সূচনা করেছিলেন। এটি শুরু হয় মাত্র একটি ছাত্রীকে নিয়ে এবং ক্রমে এই সংখ্যা ১৯৪৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬। এরপর জে.এম. সেন মহাশয় অধ্যক্ষ হন। তিনি অধ্যক্ষ থাকার সময় কৃষ্ণনগর কলেজ একাধিক বিষয়ে উন্নতি লাভ করেছিল। তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার সময় থেকে কৃষ্ণনগর কলেজে একাধিক কোর্স শুরু হয়। জে.এম. সেন মহাশয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল তিনি কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৩২টিরও বেশি স্কলারশিপ, বৃত্তি, পুরষ্কারের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও তিনি ছাত্রদের কমনরুম লাইব্রেরি, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্ররা তাদের সাধ্যমতো অংশগ্রহণ করেছিল। সেই সময় সুরেন্দ্রনাথ ও বিপিনচন্দ্রের বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য অনেকের হয়েছিল। কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্ররা প্রায়ই স্বদেশী শোভাযাত্রায় যোগ দিত। এই সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন রায়বাহাদুর জ্যোতিভূষণ ভাদুড়ী। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে দুটি গান খুবই জনপ্রিয় ছিল- “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই” আর “একবার তোরা মা বলিয়া ডাক”। গান্ধীজী যখন সমগ্র দেশকে ১৯৩০-র ২৬শে জানুয়ারি ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালন করবার জন্য আহ্বান জানান তখন কৃষ্ণনগর কলেজে সেই দিনটি পালন করা উপলক্ষে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্ররা সমগ্র শহরের মোড়ে মোড়ে তোরণ নির্মাণ করেন এবং প্রধান রাস্তা ধরে মিছিল করে ‘স্বরাজ পার্ক’ (মোমিন পার্ক)-এ সমবেত হয়ে মূল অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। তবে কলেজ হোস্টেলে জাতীয় পতাকা (তখন কংগ্রেসের পতাকাকে জাতীয় পতাকা বলা হত) উত্তোলন নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্রদের গণ্ডগোল হয়। পরেরদিন কলেজের অধ্যক্ষ হোস্টেলের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্রকে (লোকেন মুখোপাধ্যায়, রঘুনন্দন বিশ্বাস, হরিচরণ প্রামাণিক) হোস্টেল থেকে বহিষ্কার করেন। এর প্রতিবাদে কৃষ্ণনগর ছাত্র সমিতির নেতৃত্বে কলেজের হোস্টল ও পরে কলেজ ধর্মঘট শুরু হয়। তিনমাস ধরে চলা কৃষ্ণনগর কলেজ ধর্মঘট সারা বাংলায় আলোড়ন ফেলে দেয়। তখনকার বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক Liberty-তে ‘Professors before empty benches’ শিরোনামে এই ধর্মঘট সম্পর্কে লেখাও প্রকাশিত হয়। বাংলার ছাত্রনেতারা কৃষ্ণনগরে এসে সংগ্রামী ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। নদিয়ার ছাত্ররা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রাদেশিক ছাত্র সংগঠন বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র সমিতি (B.P.S.A) এবং নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি ( A.B.S.A) উভয়েরই সহযোগিতা লাভ করে। এরপর গান্ধীজীর ঐতিহাসিক ডান্ডি অভিযানের সময় কৃষ্ণনগর কলেজের একদল ছাত্র (জগন্নাথ মজুমদার, কেদারনাথ মুখোপাধ্যায়, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদানন্দ দাশগুপ্ত ও অমরেশ বিশ্বাস) জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক তারকদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে সত্যাগ্রহী স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ ও সত্যাগ্রহের বার্তা নদিয়ার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে জেলা সফরে যান। এইভাবে কৃষ্ণনগর কলেজের কৃতী ছাত্ররা শিক্ষা অর্জনের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে দেশের কাজে এগিয়ে আসেন।

কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র উমেশচন্দ্র দত্ত প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় যুগের এক কৃতী ছাত্র ছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর সুগভীর জ্ঞান ছিল। তিনি রামতনু লাহিড়ীর অনুজ শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ীর অবৈতনিক ইংরাজি বিদ্যালয় থেকে কৃষ্ণনগর কলেজে এসেছিলেন। ‘ক্ষিতীশ-বংশাবলি-চরিত’ থেকে জানা যায় যে, মহামতি লর্ড হার্ডিঞ্জ কর্তৃক কৃষ্ণনগর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে, শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ী নিজের ছাত্রদের সেখানে প্রবিষ্ট করে নিজের স্কুল উঠিয়ে দেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র দত্ত ছাড়াও, শ্রীনাথ সেন প্রভৃতি কয়েকজন কলেজের প্রথম বছরের পরীক্ষাতেই জুনিয়ার ছাত্রবৃত্তি পান। উমেশচন্দ্র দত্ত ১৮৪৯ সালে সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় বাংলার ছাত্রদের মধ্যে প্রথম হন। Council of Education-এর সদস্য বেথুন সাহেব কৃষ্ণনগর কলেজের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী সভায় উমেশচন্দ্র দত্তের ভূয়সী প্রশংসা করেন। উমেশচন্দ্র দত্ত পরবর্তীকালে এই কলেজের অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। বাংলার সুপ্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ কৃষ্ণনগর কলেজের থেকে শিক্ষালাভ করেছিলেন। ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহ চলাকালে তিনি অত্যাচারিত নীলচাষীদের পক্ষে লেখনী ধারণ করেন। ১৮৬১ সালে তিনি ‘Indian Mirror’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।  ১৯২৭ সালে মনমোহন ঘোষের বাসভবনে কলেজিয়েট স্কুল স্থানান্তরিত হয়। তার ভাই লালমোহন ঘোষও কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি পরবর্তীকালে কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে (১৯০৩ খ্রি.) সভাপতিত্ব করেন। লালমোহন ঘোষ জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (‘চক্রবর্তী দেওয়ান’-এর বংশ হেতু ‘রায়’ উপাধি) কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৮৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন এবং ১৮৮০ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে স্কলারশিপ নিয়ে এফ.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে ১৮৮৬ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সেন্ট্রাল প্রভিন্সে সার্ভে ও সেটেলমেন্ট অফিসে ডি.এল. রায় (সাহেবিয়ানার ফলে ‘ডি.এল. রায়’ নামই বেশি ব্যবহৃত হত। তৎকালে তাঁর প্রকৃত নাম পরিবর্তিত হয়েছিল ‘Mr. Dwijen Lala Ray’-এ) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। পি.এন. বোস, সতীশচন্দ্র আচার্য, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরাও কৃষ্ণনগর কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। বাংলার সুপরিচিত বিজ্ঞানী পি.এন. বোস জামশেদপুরের কাছ থেকে আকরিক লোহা আবিষ্কার করেন। তিনি কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে এফ.এ. পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন। সতীশচন্দ্র আচার্য মহাশয় বি.এ. পরীক্ষায় সংস্কৃততে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। ইনি পরবর্তীকালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। শ্রদ্ধেয় ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এফ.এ. পরীক্ষায় এই কলেজ থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীও একসময় কৃষ্ণনগর কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। কবি ও সাংবাদিক বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে ছাত্র থাকাকালীন অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন।

অবিভক্ত নদিয়া জেলায় ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ই একমাত্র কলেজ ছিল। প্রতিবেশী জেলাগুলির শিক্ষার্থীরাও এই কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছিলেন। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাশ্চাত্য তথা আধুনিক শিক্ষার প্রসার দ্রুতগতিতে হতে থাকে। অবিভক্ত বাংলার নদিয়া জেলায় এই কলেজের আবির্ভাব উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়াতে থাকে। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে পাশ করা মেধাবী ছাত্ররা পরবর্তীতে বাংলার বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, ব্যারিস্টার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, স্বাধীনতা সংগ্রামী ইত্যাদি নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কৃষ্ণনগর কলেজের কৃতী শিক্ষার্থীরা নদিয়া জেলা তথা বাংলার গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। কৃষ্ণনগর কলেজ তার প্রথিতযশা শিক্ষক, পরিশ্রমী ছাত্রবর্গ ও নদিয়াবাসীর আন্তরিক সহযোগীতাকে সাথে নিয়ে প্রথম একশত বছরের পথ সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করে। আজ এই কলেজ তার দুইশত বছর অতিক্রম করার পথে। সূচনাকাল থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া কালে কৃষ্ণনগর কলেজকে একাধিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন হতে হয়। তবে সেই সকল সংকটময় পরিস্থিতি কাটিয়ে কৃষ্ণনগর কলেজ তার সমৃদ্ধি বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়েছিল। এবার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর সেই গুরু দায়িত্ব বর্তাবে।

দীপাঞ্জন দে - আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক, নদিয়া। কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের প্রাক্তনী।