logo

রেউই গ্রাম থেকে কৃষ্ণনগরে রূপান্তরিত এই জনপদ মধ্যযুগে তার নাগরিক চরিত্র লাভ করে। বর্তমানে এটি নদিয়া জেলার সদর শহর। এখানে একাধিক ঐতিহাসিক স্মারক রয়েছে, যেগুলি আঞ্চলিক ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদ। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি যেমন মৃৎশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। ঘূর্ণির মৃৎশিল্পের সুনাম সর্বজন বিদিত। আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘূর্ণির কারিগরদের তৈরি ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায়। এবার কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের প্রসঙ্গে আসা যাক। একদা এটি ছিল বিখ্যাত ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের নিবাস। মনমোহন ঘোষ (১৮৪৪-১৮৯৬ খ্রি.) ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় ব্যারিস্টার। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল স্থাপিত হয় ১৮৪৬ সালে। একই সঙ্গে কৃষ্ণনগর কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে তিনজন ইউরোপীয় শিক্ষক এবং দশজন ভারতীয় শিক্ষক নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠন শুরু হয়। বঙ্গের গৌরব ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষ তাঁর বাড়িটি স্কুলকে দান করেন। পরবর্তীতে সেখানেই স্কুল স্থানান্তরিত হয়। এখানে শিক্ষকতা করেছেন রামতনু লাহিড়ী, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, বেণীমাধব দাসের মতো ব্যক্তিরা। কৃষ্ণনগরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো এ ভি হাইস্কুল। বিশিষ্ট শিক্ষক বাবু ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগরের নেদিয়ার পাড়ায় অ্যাংলো ভার্নাকুলার হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লোকমুখে ‘ব্রজবাবুর পাঠশালা’ নামেই পরিচিতি পেয়েছিল। ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের অন্যতম পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সি এম এস স্কুলের শিক্ষক। পরবর্তীতে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ২০২৩ সালে কৃষ্ণনগর এ ভি হাইস্কুল ১৭৫তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহু কৃতি ছাত্র পাস করে বার হয়েছে। বিপ্লবী বাঘাযতীন কৃষ্ণনগরের অ্যাংলো ভার্নাকুলার হাইস্কুল থেকেই ১৮৯৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স পাস করেন। বিখ্যাত নাট্যকার ও কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে পড়তেন বলে জানা যায়। শহীদ অনন্তহরি মিত্র, স্বাধীনতা সংগ্রামী অমৃতেন্দু মুখার্জি প্রমুখরা এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। কৃষ্ণনগরের অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ। কিন্তু এই হেরিটেজ ভবনটি বর্তমানে জরাজীর্ণ। নদিয়া-রাজ শ্রীশচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ প্রথম স্থাপিত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান ভবনটিকে হেরিটেজ সৌধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৭৬৯ শকাব্দে (অর্থাৎ ১৮৪৭ খ্রি.) এই ভবন নির্মিত হয়েছিল।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নহবৎখানা হলো একটি অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন। সম্প্রতি এই ঐতিহাসিক সৌধে সিমেন্ট বালির আস্তরণ চাপিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। নদিয়া-রাজের রাজধানী মাটিয়ারী থেকে কৃষ্ণনগরে স্থানান্তরিত হওয়ার পর সেখানে রাজপ্রাসাদ, চক, নহবৎখানা প্রভৃতি নির্মাণ করা হয়। মহারাজা রুদ্র রায়ের আমলে মাটি, চুন সুরকির গাঁথনিতে ইটের তৈরি চারমিনার বিশিষ্ট তোরণরূপী এই নহবৎখানাটি নির্মিত হয়েছিল।

নদিয়া রাজবংশের সূচনা ধরা হয় ভবানন্দ মজুমদারের সময় থেকে। রামচন্দ্র সমাদ্দারের চার ছেলে ছিল। যাদের মধ্যে সবথেকে বড় ছিলেন ভবানন্দ। তিনি বাগোয়ান থেকে মাটিয়ারীতে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। পরবর্তীতে নদিয়া-রাজ রাঘব রায় সিংহাসনে বসে মাটিয়ারী থেকে রেউই গ্রামে রাজধানী স্থানান্তর করেন। রেউই গ্রামে ছিল গোপেদের বাস। সেই সময় মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন সম্রাট শাহজাহান। মহারাজা রাঘব রায়ের পরে তাঁর পুত্র রুদ্র রায় সিংহাসনে বসেন। মহারাজা রুদ্র রায়ের রাজত্বকালে (১৬৭৬-১৬৯৩ খ্রি.) রেউই থেকে কৃষ্ণনগর নামকরণ হয়। রেউই গ্রামের অধিবাসী গোপেরা ঘটা করে শ্রীকৃষ্ণের পুজো করতেন। সে কারণেই মহারাজা রুদ্র রায় রেউই গ্রামের নাম রাখেন কৃষ্ণনগর। এভাবেই মধ্যযুগে কৃষ্ণনগর শহর জন্ম নেয়। সেই সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন ঔরঙ্গজেব।

বিশিষ্ট স্থপতিকার আলাল দোস্তের সমাধি পীরতলা রাজবাড়ির সন্নিকটে অবস্থিত। মহরমের দিন এখানে মেলা বসে। বাবু রামতনু লাহিড়ীর বসতবাড়ির কিয়দংশ এখনো কৃষ্ণনগরে রয়েছে। ১৯৮১ সাল থেকে রামতনু লাহিড়ীর এই বাড়িতে ‘কৃষ্ণনগর একাডেমী’ নামে একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল স্থাপিত হয়েছে। কৃষ্ণনগর রেল স্টেশনের সন্নিকটে রয়েছে বাংলার প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিক নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মভিটে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা ছিলেন নদিয়া রাজবংশের দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায়। তাঁদের পৈত্রিক ভিটের কিয়দংশ রয়েছে কৃষ্ণনগর রেলস্টেশন সংলগ্ন একখণ্ড জমিতে। রাস্তার (স্টেশন রোড) অপর দিকে দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিধন্য দ্বিজেন্দ্র পাঠাগার রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য কৃষ্ণনগরের অন্যতম হেরিটেজ সৌধ হলো গ্রেস কটেজ। এই বাড়িটিতে নজরুল ইসলাম প্রায় আড়াই বছর (১৯২৬-১৯২৮ খ্রি.) সপরিবার বসবাস করেছিলেন। ‘দারিদ্র’ কবিতা, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের রচনা এই বাড়িতেই। এখানেই সৃষ্টি হয় প্রথম বাংলা গজল গানের। কৃষ্ণনগরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য একটি হেরিটেজ ভবন হলো রানিকুঠি। এটি ছিল সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীদের পৈতৃক নিবাস। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন এবং এই বাড়িটিতে তিন চার দিন ছিলেন বলে জানা যায়। নদিয়া জেলার একটি অন্যতম প্রাচীন গির্জা হলো কৃষ্ণনগর ক্যাথিড্রাল। এটি গঠন ও নকশার দিক থেকে অন্যান্য গির্জার থেকে অনেকটাই আলাদা। গথিক, নিও-ক্লাসিক্যাল বা ভিক্টোরিয়ান নয়, একাধিক স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রণে ১৮৯৯ সালে কৃষ্ণনগর ক্যাথিড্রালের বর্তমান ভবনটি নির্মিত হয়। কয়েক বছর আগে কৃষ্ণনগর ক্যাথিড্রালের প্রায় সম্মুখে নির্মিত হয়েছে আরেকটি বিশাল স্থাপত্য। যার নাম দেওয়া হয়েছে খ্রিস্টমন্দির। এর পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে কৃষ্ণনগরের লুপ্তপ্রায় জলধারা অঞ্জনা। কৃষ্ণনগর কলেজ (বর্তমান নাম কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ) হলো নদিয়া জেলার প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর সমগ্র বাংলার মধ্যে এটি হলো তৃতীয় প্রাচীন কলেজ। এটি হলো শহরের অন্যতম ঐতিহাসিক স্মারক। গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জের সময়কালে (১৮৪৪- ১৮৪৮ খ্রি.) এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণনগরে স্থাপিত হয়। বিখ্যাত শেক্সপিরিয়ার বিশেষজ্ঞ স্যর ডি এল রিচার্ডসন ছিলেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। তিনি ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ নভেম্বর অধ্যক্ষের দায়িত্বভার পেয়ে যান। যদিও কৃষ্ণনগর কলেজের প্রতিষ্ঠাকাল হলো ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি। জাতপাত নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি উন্মুক্ত ছিল। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজ একসঙ্গেই পথচলা শুরু করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম যৌথ শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে অধ্যক্ষ ডি এল রিচার্ডসন ছাড়াও আরো তিনজন ইউরোপীয় শিক্ষক ছিলেন— ব্রাডবুরি, বিটসন ও বিনল্যান্ড। এছাড়াও ছিলেন দশজন ভারতীয় শিক্ষক।